বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পলিথিন চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ কারণে প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশ সরকার ১ জানুয়ারি ২০০২ ঢাকা শহরে এবং ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারা দেশে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন কিছুদিন পাটের (চটের) ও কাগজের ব্যাগের ব্যবহার সাময়িক সময়ের জন্য লক্ষ করা গেলেও প্রচার-প্রচারণা এবং মানুষের অসচেতনতার অভাবে আবার পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
পাট পরিবেশবান্ধব, বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। শিল্প বিপ্লবের সময় ফ্লাস্ক এবং হেম্পের স্থান দখল করে পাটের যাত্রা শুরু। বস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পাট এখনও গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সঙ্গে মিশ্রণ করে ব্যবহার করা যায়। প্রচলিত বয়ন শিল্পে পাটের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং ইত্যাদি। পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, ইত্যাদি পাট থেকে তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে মিশ্রণ করা হয়।
কৃষিপণ্য এবং অন্যান্য দ্রব্য বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য ব্যাপকভাবে পাট ব্যবহার করা হয়। পাটখড়ি পাট চাষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। পাট আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ খড়ি উৎপাদিত হয়। ঘরের বেড়া, ছাউনি এবং জ্বালানি হিসেবে খড়ির ব্যবহার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রঙ ইত্যাদি। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটখড়ি ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ড. মোবারক আহমেদ খান, যা ‘সোনালি ব্যাগ’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পাটের কচি পাতাকে শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। চট্টগ্রামে অঞ্চলে এটি ‘নারিস শাক’ হিসেবে খুবই পরিচিত।
বাংলাদেশের ভূমি ও আবহাওয়া পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, জামালপুর এবং ঢাকা জেলায় অধিক পরিমাণে পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে। ৯০-এর দশকে এ দেশে পাট উৎপাদন হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমেই সেই পাটের জমির পরিমাণ কমতে কমতে ৩০-৪০ বছর ধরে ৪ বা সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে পরিবেশ সচেতনতা, প্রাকৃতিক আঁশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে সেই জমির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ লাখে এসেছে। তবে অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তার উৎপাদন পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। যেখানে আগে ১২ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৬০-৬৫ লাখ বেল পাট পাওয়া যেত, সেখানে বর্তমানে মাত্র ৭-৮ লাখ হেক্টর জমিতেই প্রায় ৮৪ লাখ বেল পাট পাওয়া যাচ্ছে। একসময় এ দেশের কাঁচা পাট ছিল বিশে^র কাছে সর্বাধিক সমাদৃত। বাংলাদেশি কাঁচা পাট প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরিকোস্ট, থাইল্যান্ডে রফতানি করা হয়। তবে পাট অধিদফতরের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে কাঁচা পাট নয়, বরং পাট খাত থেকে রফতানি আয়ের বেশির ভাগ আসে পাটজাত পণ্য থেকে, যা ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানাসহ আরও কিছু দেশে রফতানি করা হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার আয় করে বাংলাদেশ। এই সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমত্রার চেয়ে প্রায় ১ শতাংশের মতো বেশি। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে চামড়া খাতকে পেছনে ফেলে তৈরি পোশাক শিল্পের পরের স্থান দখল করে নেয় পাট খাত।
এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৬৮৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এসেছে পাট ও পাট পণ্য রফতানি থেকে। এই দুই মাসে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রফতানি হয়েছে ১৪ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। কাঁচা পাট রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার; আয় বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। আয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাট ও পাট সুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। এছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছিল। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটসুতা রফতানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রফতানি ৬৪ শতাংশই এসেছিল পাটসুতা রফতানি থেকে। কাঁচা পাট রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। এ ছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছিল ১৯ কোটি ডলারের।
আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পাট শিল্পের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এই শিল্প আমাদের অর্থনীতির চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এ দেশের লাখ লাখ কৃষকের অবলম্বন এই পাট। কর্মসংস্থান, অর্থ উপার্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বোপরি এই দেশের ঐতিহ্য ও নিজস্বতা রক্ষায় পাট শিল্পের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আধুনিকতার পদতলে নিষ্পেষিত যখন পুরো পৃথিবী, দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন পাট শিল্পের যথাযথ ব্যবহার আমাদের বাঁচাতে পারে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ভয়াবহতা থেকে। এ শিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। এ শিল্প বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচায়ক। সরকারের সজাগ দৃষ্টি ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে আমাদের এই শিল্পকে এবং ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য, নিজস্বতার ধারক এই পাট শিল্পকে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত পাট উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম এবং পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতেও প্রথম স্থানে রয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পাট শিল্পের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এই শিল্প আমাদের অর্থনীতির চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। পাট খাতকে বাঁচাতে হলে, পাট শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাট উৎপাদন বাড়াতে হবে, কৃষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা পাটের ন্যায্য দাম পায়। বৃহত্তম পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশনকে (বিজেএমসি) কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি পাটকলগুলোর মানোন্নয়নে সরকারকে মনোযাগী হতে হবে। তবেই পাটের অর্থনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। আধুনিকতার পদতলে নিষ্পেষিত যখন পুরো পৃথিবী, দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন পাটের যথাযথ ব্যবহার আমাদের বাঁচাতে পারে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ভয়াবহতা থেকে।