‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলতে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সরকারের এমন এক সম্মিলিত ব্যবস্থাপনাকে বোঝায়; যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর, দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণসহ ও সেবা কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজেশন করা। পাট শিল্পের জনপ্রিয়তার অবদানকে সামনে আনার জন্য বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন ‘পাট শিল্পের অবদান স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ এ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক দশক আগে, বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের চেয়ে কম মূল্যের বিকল্প পণ্য হিসেবে পলিথিন, প্ল্যাস্টিক, নাইলন, সিনথেটিক ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পেতে থাকে। এতে পাটপণ্যের দামও কমতে থাকে এবং কৃষকেরা পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাটের পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন পণ্য উদ্ভাবন হয়, যা পরিবেশের জন্য কোনো হুমকি নয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের উদ্ভাবিত ‘সোনালি ব্যাগ’
এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। আশা করা যায়, সোনালি ব্যাগ অদূর ভবিষ্যতে পাট অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
পাট কৃষিপণ্য হওয়ার আগে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে রপ্তানি হতো। কিন্তু বর্তমানে পাট বাংলাদেশের কৃষিপণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত এবং সে লক্ষ্যে পাটকে জনপ্রিয় করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০২৩ সালকে পাটপণ্যের বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং পরে তার ধারাবাহিকতায় ২৬ ফেব্রুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। পহেলা মার্চ সে প্রজ্ঞাপনের গেজেট জারি করা হয়। এতে সুবিধাস্বরূপ হচ্ছে, কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে যে সব সুবিধা পাওয়া যাবে, পাটের ক্ষেত্রেও তা পাওয়া যাবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাটের আঁশের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাট অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জুন মাসে কাঁচা পাট রপ্তানিতে শীর্ষে আছে পপুলার জুট একচেঞ্জ লিমিটেড। এ কোম্পানি ২৫,৩২৫২ বেল পাট বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। তার পরেই রয়েছে তাসফিয়া জুট ট্রেডিং। এ কোম্পানি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জুন মাসে ২২,৯৭৬৭ বেল পাট বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, জিবুতি প্রমুখ। কাঁচা পাটকে আরও রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপান্তর করতে পারলে পাট থেকে আমাদের দেশ অন্য আরও দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। পাট এমন একটি পণ্য যার শেকড় হতে শুরু করে পাতা, আঁশ, পাটকাঠি ও পাটের বর্জ্যসহ সব ব্যবহারযোগ্য। বহুবিধ সিনথেটিকের ব্যবহার পরিহার করে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জ্যামিতিক হারে বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়ছে। পাটের গতানুগতিক পণ্য হচ্ছে সুতা, থলি, চট, দড়ি, সুতলি ইত্যাদি। কিন্ত শুধু গতানুগতিক পণ্য দিয়ে পাট শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এ জন্য পাট শিল্পের আধুনিকায়ন প্রযুক্তি দরকার। যদিও পাট শিল্পের নানাবিধ সমস্যা যেমন পাটের গুণগত মান হ্রাস, পাটের বিষয়ে উপযুক্ত কারিগরি জ্ঞানের অভাব ইত্যাদি বিদ্যমান। তথাপি বর্তমানে গবেষণা উন্নয়নের মাধ্যমে পাটের অনেক প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। যার মাধ্যমে পাটের স্মার্ট ব্যবস্থাপনা বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়।
বিশ্বে পরিবেশদূষণ ও পরিবেশের অবনমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ। পরিবেশদূষণ মূলত সিনথেটিক ব্যবহারের কারণে বেড়েছে। এজন্য পরিবেশবিদরা প্রাকৃতিকভাবে পচনশীল এমন পণ্য উদ্ভাবন করার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে পরিবেশের ওপর প্রভাব না পড়ে। এমন বাস্তবতায় পাটের তৈরি পণ্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এ দেশের উর্বর পলিমাটি, অত্যধিক বৃষ্টিপাত ও গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া পাট চাষের জন্য উপযোগী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাঁধ ও নদীভাঙন রোধে পাটের বস্তা ব্যবহার বাড়ছে। ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বিবিসি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে পাটের দাম ও চাষ বাড়ছে, সোনালি আঁশের দিন কি আবার ফিরে আসছে’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, যেখানে এক মণ চালের দাম ১৬০০-২০০০ টাকা; সেখানে এক মণ পাটের আঁশের মূল্য ৩০০০-৩২০০ টাকা, যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। বহুবিধ পাটের ব্যবহারের মধ্যে আছে পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল; যা ভূমি ক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাট ও পাট জাতীয় আঁশ থেকে তৈরিকৃত জুট জিও টেক্সটাইল পণ্য কৃষি ও ভূ-তাত্ত্বিক প্রকৌশলে ব্যবহার হচ্ছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে পাটের উপযোগিতা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে।
২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশে কৃষি উন্নত করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে। যাতে উন্নত উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত বৈচিত্র্য আসে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে পাটজাত দ্রব্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৭,১৯৮.৩৮ কোটি টাকা (পাট অধিদপ্তর)। যা পূর্বের অর্থবছরের তুলনায় ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে অগ্রসর হচ্ছে, যা বাংলাদেশে স্মার্ট পণ্য উৎপাদনের পথকে সুগম করছে। সর্বোপরি স্মার্ট ইকোনমি হিসেবে পাটের মূল্য সংযোজিত বহুমুখী পণ্যের উদ্ভাবন হলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। কৃষক ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। পাটকে সামনের দিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে বহুমুখী মূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে পাট পাতা থেকে খাদ্যতালিকায় পাট পাতার ভেষজ চা, বিস্কুট, রোজেলা ড্রিংকস ও পাট শাক স্বাস্থ্যগত ভূমিকা রাখছে। বর্তমনে পাটকাঠি থেকে বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি চারকোল ও অ্যাক্টিভেটেড কার্বন তৈরি পাটের সুদিন খুলে দিয়েছে। পাটের নান্দনিক ফেব্রিক্স থেকে নান্দনিক ক্যালেন্ডার, স্যান্ডেল, ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, ফ্লোর ম্যাট, অফিস ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, নার্সারি পট, পর্দার কাপড়, স্কুল-কলেজ ব্যাগ, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ডেনিম প্যান্ট, শো-পিস, জুট জিও-টেক্সটাইল, পেপার অ্যান্ড পাল্প, সিটার, কুশন কাভার, ফ্লোর ম্যাট, লেডিস পার্স, পাটের কম্পোজিট ইত্যাদি প্রস্তুত হচ্ছে। সেগুলো বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
পাটের স্মার্ট প্রযুক্তি বিবেচনা করার জন্য কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন:
সেন্সর ও নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম: সেন্সর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পাট ফসলের মানসম্পর্কিত ডেটা সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, যাতে উচ্চমানের পাটের তন্তু উৎপাদন সহজ করা যায়।
স্মার্ট ফার্মিং ও পরিচ্ছন্নতা: সেন্সিং প্রযুক্তি, ডেটা অ্যানালাইসিস এবং কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাট চাষের বিষয়ে কৃষকদের প্রাথমিক তথ্য প্রাপ্তি এবং ফলাফলের ভিত্তিতে সাহায্য করা যেতে পারে।
পাটবিজ্ঞানী ও পাট মিল মালিকদের মধ্যে যুগপৎ সেতুবন্ধন: পাট থেকে বহুবিধ পণ্য ও যে সব প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে, তা সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোক্তা ও পাট মিল মালিকদের সদিচ্ছা তৈরি করা প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনার জন্য শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও পাটপণ্য ব্যবহারে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।