জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের জন্য দুটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশে পচনরোধী প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য, উপজাত, কণিকা বা প্লাস্টিকের দ্রব্য নিঃসরিত অণুর সংযোজন, যা মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বণ্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক ও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে বিকল্প প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাটের। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়Ñ এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদনকারী দেশ এখন বাংলাদেশ। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও মাটি পাট উতপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে।
মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক দূষণ পৃথিবীতে নানা রকম ইকোসিস্টেমের জন্য এক ভয়ংকর বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্লাস্টিক ও ন্যানো প্লাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ জীবের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন এবং ক্যান্সারসহ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হতে পারে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ। এর ফলে প্রতিবছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং বিশাল তিমি মাছসহ ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা পড়ছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, প্রতিদিন ৮০ লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। এভাবে জমতে জমতে বড় বড় মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা (প্যাচ) তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশান্ত মহাসাগরে বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্যাচের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। অনুরূপ প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা অন্যান্য মহাসাগর এবং সাগরেও সৃষ্টি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, সমুদ্রের পানির উপরিস্তরের প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ কম-বেশি প্লাস্টিক দূষণে দূষিত।
উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিমতন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর শিল্প-রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্গানিক বা পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব জানার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের বিকল্প সন্ধান করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এ ক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন।
মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম। পাট ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির ওপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলি ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। পাট ফসল উতপাদনকালে হেক্টরপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় টন পাট পাতা মাটিতে পড়ে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়া পাট ফসল কর্তনের পর জমিতে যে পাটগাছের গোড়াসহ শিকড় থেকে যায় তা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার যোগ করে, যা জমির ঊর্বরতা ও মাটির গুণগত মান বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। এ কারণে যে জমিতে পাট চাষ হয়, সেখানে অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়।
বিশে^ প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এ বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের চার শতাংশ ব্যবহূত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ জৈববিয়োজনশীল নয়। একটন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে দুই গিগা জুল তাপে ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপে ১হাজার ৩৪০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের উষ্ণায়নের ১০-১৩ শতাংশ অবদান হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর মাধ্যমে। এসব ক্ষতিকারক বিবেচনা করে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য এবং চিনি মোড়কজাত করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশের পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরির চিন্তাভাবনা চলছে। এজন্য বিশ্ববিখ্যাত কানাডিয়ান ফেল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কান্ট্রি প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে। প্লাস্টিকের সঙ্গে ৩০ ভাগ পাট মিশিয়ে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি করা হবে, যা পরিবেশবান্ধব হবে।
পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী সোনালী আঁশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরার লক্ষ্যে পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ বা বর্ষপণ্য ২০২৩ এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা করেছে সরকার। সরকার বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উদ্ভাবন, ব্যবহার সম্প্রসারণে গুরুত্বারোপ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি পাট চাষসহ পাটখাতের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩’, ‘পাট আইন, ২০১৭’, জাতীয় পাটনীতি, ২০১৮’ এবং ‘চারকোল নীতিমালা, ২০২২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)-এর নিবন্ধিত উদ্যোক্তাগণ বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক গুণসম্পন্ন নতুন নতুন ডিজাইনের বহুমুখী পাটপণ্য উতপাদন এবং বিশ্ববাজারে বহুমুখী পাটজাতপণ্যকে জনপ্রিয় করতে প্রচার প্রচারণাসহ বিদেশে বিভিন্ন মেলার আয়োজন করার কাজ চলমান রয়েছে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে উতসাহিত করার লক্ষ্যে পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা প্রদান করছে সরকার।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রীণ ইকোনোমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তার পর এবার বিশ্ব বাজারে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হচ্ছে। হাতে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত পণ্য ও কার্পেট মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাঁধ ও নদী ভাঙনরোধে পাটের বস্তা ব্যবহার বাড়ছে। পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে কয়েক গুণ। পাটের ২২ জাতের সুতা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪টি দেশে। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে প্যাকিং সরঞ্জাম, স্মার্ট পাটের ব্যাগ, পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, জুতা, স্যান্ডেল ও বাসকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এছাড়াও যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে দাতা সংস্থার ত্রাণসামগ্রী উড়োজাহাজ থেকে নিচে ফেলতে পাটের দড়ি ও বস্তার চাহিদা বেড়েছে। পাটের কফিন ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহূত হচ্ছে।
বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাটচাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক বাজারে স্বদেশি পাটপণ্যের কার্যকর ব্রান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া এবং পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পাটের মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।